নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর ছোট বনগ্রামে সাব্বির নামের এক যুবককে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। হত্যার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত গোলাপ হোসেনকে রক্ষা করে নিরীহ তিন যুবক—বাদশা, শান্ত ও অন্তরকে মামলায় জড়ানোর প্রতিবাদে চন্দ্রিমা থানার সামনে অবস্থান কর্মসূচি ও মানববন্ধন করেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষ।
সোমবার (৫ মে) বিকেলে কোটাপুকুর মোড়ে শুরু হওয়া এ কর্মসূচি পরে রূপ নেয় থানা ঘেরাও আন্দোলনে। বিক্ষোভকারীদের দাবি—প্রকৃত হত্যাকারীকে বাদ দিয়ে মিথ্যা মামলায় নিরপরাধদের ফাঁসানো হয়েছে, যার পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী চক্র ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তার উদাসীনতা।
হত্যাকাণ্ডের পেছনে পুরনো দ্বন্দ্ব, প্রভাবশালী আসামিকে বাঁচানোর অভিযোগ
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, নিহত সাব্বিরের সঙ্গে গোলাপ হোসেন ও তাঁর সহযোগী মিজানুর ও আব্দুল্লাহর মধ্যে পুরনো টাকার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। ঘটনার আগমুহূর্তে গোলাপ হোসেনকে ঘটনাস্থলের আশপাশে দেখা গেছে বলে দাবি করেছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী এবং এলাকার একটি বেসরকারি পর্যবেক্ষণকারী দল। সিসিটিভি ফুটেজেও গোলাপের উপস্থিতি নথিভুক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
নিরীহদের ফাঁসানো, পরিবারে অশ্রু-বিদ্রোহ
এজাহারে যাদের নাম রয়েছে—বাদশা, শান্ত ও অন্তর—তাঁদের পরিবারের দাবি, ঘটনার সময় তাঁরা কেউ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। বাদশার পিতা মো. বাচ্চু শেখ বলেন, “আমার ছেলে কোনো দিন কারও ক্ষতি করেনি। অথচ আজ খুনের আসামি হয়ে সমাজে মুখ দেখানো যাচ্ছে না।” শান্তর পিতা মো. শাজাহান শেখ ও অন্তরের পিতা মো. আব্দুল মান্নানও কান্নাজড়িত কণ্ঠে একই অভিযোগ তোলেন।
নারীরাও এ বিক্ষোভে অংশ নেন। মোসা. সুরিনা বেগম বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। আমাদের ছেলে-মেয়েরা কষ্ট করে বাঁচে। তাদের এভাবে জড়ানো অন্যায়। আমরা সুবিচার চাই।”
আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে মামলার প্রধান সাক্ষী মো. নজরুলের ভূমিকা। এলাকাবাসীর অভিযোগ—হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ঘটনাস্থলের রক্ত মুছে ফেলেন। অথচ তাকেই মামলার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, নজরুল হলেন গোলাপ হোসেনের আত্মীয়—ভাগ্নির জামাই ও দুলাভাই—যা তাঁর নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্তে তাদের নাম পাওয়া গেছে।
কিন্তু স্থানীয়রা এই বক্তব্যকে ভিত্তিহীন দাবি করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ, মামলার ১ নম্বর আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বাদশা, শান্ত ও অন্তরের নাম উল্লেখ করেননি। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ—সিসিটিভি, প্রত্যক্ষদর্শী, এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষণ—সবই অন্য একটি চিত্র উপস্থাপন করে।
বিক্ষোভকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন—তদন্ত কর্মকর্তা যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকতেন, তবে গোলাপ হোসেনকে কেন এজাহার থেকে বাদ দেওয়া হলো? এ ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত পুলিশি পেশার প্রতি মানুষের আস্থাকে আরও দুর্বল করছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
মানববন্ধন শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা সরাসরি চন্দ্রিমা থানায় যান এবং সুনির্দিষ্ট দাবি পেশ করেন।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিক্ষোভকারীদের আশ্বস্ত করেন—তদন্তে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না এবং সব অভিযোগ পুনর্বিবেচনা করা হবে।
সুবিচার না এলে আন্দোলন চলবে
এলাকাবাসীর স্পষ্ট বক্তব্য—“একটি খুন হয়েছে, অথচ প্রকৃত খুনি বাইরে আর নিরীহরা আত্মগোপনে—এটা কেমন বিচারব্যবস্থা?”
তাঁরা চাচ্ছেন না প্রতিশোধ, চাচ্ছেন কেবল সত্যের জয়। “আমাদের ছেলে নির্দোষ। আমরা বিচার চাই, প্রতিশোধ নয়,”—এই কণ্ঠস্বর এখন পুরো ছোট বনগ্রামে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
এখন এলাকাবাসী চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষ দ্রুত হস্তক্ষেপ করুক এবং এই মামলার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।