নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম মন্ডল। বর্তমানে তিনি রুয়েটের উপাচার্য দৌড়ে আছেন। কিন্তু বিধি ভঙ্গের দোষে অভিযুক্ত তিনি। গবেষণার কাজ দেখিয়ে ছুটির অপব্যবহার, একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সভার আদেশের অমান্য, ‘লিয়েন লিভ’কে ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ করার জন্য চাপ প্রয়োগ, রাজনীতির সাথে সক্রিয় সম্পৃক্ততার মতো বেশ কয়েকটি বিধি বর্হিভূত কর্মকান্ডের কারণে বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি।
এ বিতর্ক এড়িয়ে সুবিধা নিতে রুয়েট প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম গবেষণার কাজ দেখিয়ে এক বছরের ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ নিয়েছিলন। কিন্তু তিনি গবেষণায় সেই ছুটি কাজে না লাগিয়ে সেটি বিধিবর্হিভূতভাবে বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এক বছরের জন্য যোগদান করেছিলেন। এতে তিনি একই সময়ে ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ দেখিয়ে রুয়েট ও বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতাসহ আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করলেও নিজ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ফাঁকি দেন তিনি। রুয়েট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি এক বছরের জন্য রুয়েট উপাচার্য বরাবর ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ এর আবেদন করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডল। দরখাস্তে ২১/০১/২০১৯ থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য ছুটির আবেদন করেন। তার ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে রুয়েট একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট স্মারক নং-২৭৬৪ এর ২২/০১/২০১৯ তারিখ বিকেলে এক অফিস আদেশের মাধ্যমে এক বছরের ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ মঞ্জুর করে। এর মধ্যে, ০৮/০৫/২০১৯ তারিখে একাডেমিক কাউন্সিলের ৯৭তম সভায় অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ওই সভার ৭ নম্বর সিদ্ধান্তে তাঁকে তাঁর কাজের একটি সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও গবেষণা স্থানসহ ‘প্রপোজাল’ জমা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ১৮/১১/২০১৯ তারিখের একাডেমিক কাউন্সিলের ১০১তম সভায় সুনির্দিষ্ট কাজের বিবরণ ও গবেষণা স্থানের উল্লেখ করে একটি ‘প্রপোজাল’ জমা দেন। কিন্তু একাডেমিক কাউন্সিল তার প্রপোজালে সন্তুষ্ট না হওয়ায় এবং ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করায় তা নামঞ্জুর করে তাঁকে কর্মস্থলে যোগদানের সুপারিশ করে। তারপরও তিনি একাডেমিক কাউন্সিলের ওই আদেশ উপেক্ষা করে পুরো এক বছর পূর্ণ করার পর ২২/০১/২০২০ সালে নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেন। এনিয়ে ২০২১ সালে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মো. জহুরুল ইসলাম সরকার।
গঠিত তদন্ত কমিটি তাঁর অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে ওই কমিটি তাঁর ‘সাবাটিক্যাল লিভ’এর পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত নীতিমালা-২০১৫ এর ১৪নং বিধি মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে বা বিদেশে বিনা বেতনে ছুটি বা ‘লিয়েন লিভ’ হিসেবে মঞ্জুর করে একটি অফিস আদেশ জারি করে।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজশাহী মহানগর শাখার ১০ নম্বর উপদেষ্টা। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে তাঁর নাম রয়েছে। অথচ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৩, ৪৪ (৫) ধারায় চাকরীর শর্তাবলীতে উল্লেখ আছে, ‘কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর রাজনৈতিক মতামত পোষণের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন না করিয়া তাঁহার চাকুরীর শর্তাবলী নির্ধারণ করতে হইবে, তবে তিনি তাঁহার উক্ত মতামত প্রচার করিতে পারিবেন না বা নিজেকে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সহিত জড়িত করিতে পারিবেন না।’
এছাড়াও, ৪৪ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সততা ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে এবং পদ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে কঠোরভাবে ন্যায়পরায়ণ ও নিরপেক্ষ হবেন।’ ৪৪ (৪) ধারায় বলা আছে- বিশ্ববিদ্যালয় অথবা উহার কোন সংস্থার স্বার্থেও পরিপন্থী কোন কার্যকলাপের সহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিজেকে জড়িত করিবেন না।’
এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মন্ডল একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক জারিকৃত আদেশ বা গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ কোনটায় মানতে নারাজ। মাস তিনেক আগেও তিনি রুয়েটের অতিরিক্ত রেজিস্টার মো. সদর উদ্দিনকে গালিগালাজ ও হুমকি ধামকি দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি নিজের দোষ মেটাতে অফিস আদেশের পরিবর্তন করাতে রুয়েটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছেন। এজন্য নিজে দৌড়-ঝাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে রুয়েট প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছেন। অধ্যাপক নজরুল ইসলামের অসৌজন্যমূলক আচরণের কথা স্বীকার করেছেন রুয়েটের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার মো. সেলিম রেজা ও অতিরিক্ত রেজিষ্টার মো. সদর উদ্দিন।
রেজিস্টার (ভারপ্রাপ্ত) মো. সেলিম রেজা ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ নিয়ে নিয়ম বর্হিভূতভাবে বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনের সত্যতার কথা স্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাডেমিক কাউন্সিল উনার বিধি বর্হিভূত কর্মকান্ড জানার পর তারা একটি কমিটির মাধ্যমে অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মন্ডলের ‘সাবাটিক্যাল লিভ’কে ‘লিয়েন লিভ’ হিসেবে মঞ্জুর করে। কিন্তু মাস খানেক আগে তিনি আবারো একটি আবেদন করেন। এখন তিনি বলছেন- ‘আমি ‘লিয়েন লিভ’ নিবো না, আমাকে ‘সাবাটিক্যাল লিভ’ দেওয়া হোক’। অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ছুটির কাগজাদি ও বেতন ভাতাদির নথির ব্যাপারে জানতে চাইলে রেজিস্টার বলেন, ‘এনিয়ে আমরা অনেকটায় বিব্রত অবস্থার মধ্যে আছি। মাস তিনেক আগে অতিরিক্ত রেজিস্টারের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন। আমাকেও তিনি এসব বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন। তাই তাঁর সব ফাইল ভিসি স্যারের কাছে হস্তান্তর করেছি। আর উনার বেতন-ভাতাদির বিষয়ে হিসাব শাখার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।’
পরের অংশ তবে হিসেব শাখার কম্পোটলার মো. নাজিম উদ্দিনের কাছে এ সম্পর্কে জানতে তিনি তথ্য না দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক কথা বলেন। হুমকি ধামকির বিষয়ে জানতে চাইলে রুয়েটের অতিরিক্ত রেজিস্টার সদর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ছোট-খাটো সাধারণ চাকরিজীবী। তার বিরুদ্ধে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমাদের না। আমাদের কাজ উর্ধ্বতনের আদেশ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। তবে উনার অসৌজন্যমূলক আচরণে আমি কষ্ট পেলেও তা কিছু মনে করিনি। ওসব আমি ভুলে গেছি।’ অভিযোগের ব্যাপারে কথা হয় অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম মন্ডলের সাথে। তিনি বলেন, ‘এখন আমি মিটিং-এ আছি, আধা ঘন্টা পরে কথা বলবো।’ আধা ঘন্টা পরে তাঁর মুঠোফোনে কল করেও তিনি না ধরায় পরে তার আর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বলেন, ‘বিশ^বিদ্যালয়ে চাকরী করে আইনের ব্যতয় ঘটানোর কোন সুযোগ নাই। ব্যতয় ঘটনালে আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব হোক আর যেই প্রভাবই হোক না কেনো, আইনের ব্যতয় ঘটানোর কোনো সুযোগ নাই। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব বিশ^বিদ্যালয়ের আইনের হেফাজত করা। যদি তিনি সেই আইনের হেফাজত না করতে পারেন তবে সেটা তার ব্যর্থতা।’ এবিষয়ে রুয়েটের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আমি সাময়িক দায়িত্বে আছি। তাই এসব জটিল বিষয় হ্যান্ডেল করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমার পর যে ভিসির পূর্ণাঙ্গ পদে আসবেন, তিনিই এইধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।’
সনি বাংলা ডট কম/-