নিজস্ব প্রতিবেদক: সাধারণত কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশে যান কর্মকর্তারা। কিন্তু রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) একটি প্রকল্পে ঘটেছে এর উল্টোটা। প্রকল্প শেষ করার পর অভিজ্ঞতা নিতে বিদেশে গেছেন আরডিএর পাঁচজনসহ মোট আট কর্মকর্তা। এই বহরে আছেন আরডিএ থেকে পাঁচ মাস আগে বদলি হওয়া চেয়ারম্যানও। রাজশাহী মহানগরীর জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি প্রকল্পের আওতায় তাদের এ ভ্রমণের কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার পর তারা ভ্রমণে বেরিয়েছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তারা দল বেঁধে গেছেন থাইল্যান্ডে।
থাইল্যান্ড ভ্রমণে যাওয়া কর্মকর্তারা হলেন- আরডিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম রহমতুল্লাহ, মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও নগর পরিকল্পক প্রকৌশলী আজমেরি আশরাফী, এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহিল তারিক, সহকারী টাউন প্ল্যানার রাহেনুল হক রনি ও পাঁচ মাস আগে বদলি হওয়া চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন। তাদের ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তাও। চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি থাইল্যান্ড সফর শেষে তারা দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে আরডিএর অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম জানিয়েছেন, মাস্টারপ্ল্যান কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে তারা থাইল্যান্ড গেছেন। মাস্টারপ্ল্যান তৈরিকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এডিপিসি এ কর্মকর্তাদের নিয়ে গেছে। তারাই প্রশিক্ষণ দেবে।
জানা গেছে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব আনওয়ার হোসেনকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। তবে নানা টালবাহানায় বদলিকৃত পদে যোগদান না করেই তিনি থেকে যান আরডিএতে। এ সময়ে তদবির করে বদলি বাতিল করান। তার নতুন পোস্টিং হয় বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক পদে। বদলির তিন মাস ২৬ দিন পর আনওয়ার হোসেন আরডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন নতুন চেয়ারম্যান যুগ্মসচিব জিয়াউল হকের কাছে।
যেদিন আনওয়ার হোসেনকে বদলি করা হয়, সেদিনই একই প্রজ্ঞাপনে যুগ্ম সচিব জিয়াউল হককে আরডিএর চেয়ারম্যান পদে বদলির আদেশ জারি হয়। কিন্তু আনওয়ার হোসেন নানা টালবাহানায় পদ না ছাড়ায় জিয়াউল হক তিন মাস ২৬ দিন বদলিকৃত পদে যোগ দিতে পারেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত ৮ জানুয়ারি আনওয়ার হোসেন আরডিএ চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন। এর কয়েক দিন পর তিনি বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডে মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। চেয়ারম্যান পদে না থেকেও আরডিএর ছয় মাস আগে একটি সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় তিনি গত ৬ ফেব্রুয়ারি গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। সাত মাস আগে শেষ হওয়া মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের আওতায় আরডিএর পাঁচ কর্মকর্তার সঙ্গে আনওয়ার হোসেনও এক সপ্তাহের থাইল্যান্ড ভ্রমণে গেছেন সরকারি খরচে।
বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা সুমন ঠাকুর জানিয়েছেন, মহাপরিচালক আনওয়ার হোসেন নিজ ডিপার্টমেন্টের কোনো কাজে যাননি। অন্য কাজে থাইল্যান্ড গেছেন। মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র আছে কিনা তাও জানেন না তিনি। তবে রেশম বোর্ডের পরিচালক ড. এমএ মান্নানকে নিজেই ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে দেশ ছেড়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২৪ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্প নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩০ জুন ছিল প্রকল্প সম্পন্নের শেষ সময়। তবে আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তবে মাস্টারপ্ল্যানের জন্য ২২ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ দেখানো হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। অব্যয়িত রয়েছে প্রকল্পের ৪ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের চার ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের জন্য চূড়ান্ত বিল তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, বেঁচে যাওয়া টাকার মধ্যে থেকে আট কর্মকর্তার জন্য ৪৮ লাখ টাকা তুলে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও জানা গেছে, ২৪ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের আওতায় বিদেশে নগর পরিকল্পনা দেখতে আরডিএর সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৬ জন এবং মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের দফা সংযুক্ত ছিল। কিন্তু প্রকল্প চলাকালীন তারা কেউ বিদেশ সফরে যাননি। তবে সংশ্লিষ্টরা প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর বিদেশ ভ্রমণে বের হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫ মাস আগে আরডিএ থেকে বদলি হওয়া আনওয়ার হোসেনও আছেন। প্রকল্পের বিদেশ ভ্রমণ দফায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উন্নত দেশের নগর পরিকল্পনা স্বচক্ষে দেখে এসে রাজশাহী মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুতে আহরিত জ্ঞান সংযোজন করবেন। এতে রাজশাহীর আগামী ২৪ বছরের নগর পরিকল্পনা সুন্দর ও সমৃদ্ধ হবে।
এদিকে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে- প্রকল্প শেষ হওয়ার সাত মাস পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ শেষে মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পে আহরিত জ্ঞান কীভাবে সংযোজন করবেন। এভাবে সরকারি প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণের যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাও জারি রয়েছে। আরও জানা গেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে আনওয়ার হোসেনের বিদেশ ভ্রমণের সরকারি ছাড়পত্র নেই।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, তিনি মাত্র গত মাসে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি ভালো জানেন না। খোঁজ নেবেন, কারা কীভাবে বিদেশ ভ্রমণে গেছেন।
সনি বাংলা ডট কম/ইআবি